সাইফুল্লাহ সাদেক
পূর্ব ইউরোপের দেশ আর্মেনিয়া সফর করবো নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে অনুভূতিগুলো চাঙা হয়ে উঠছিলো। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের যে ঐতিহাসিক সূত্র বিদ্যমান তা অনুভূতিকে আরো প্রবল করেছে। ১৯ জুলাই ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাই দুবাই ফ্লাইট করে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এরপর তিন ঘণ্টার ট্রানজিট শেষ করে সেখান থেকে ইয়েরেভানের ফ্লাইট। দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে আমরা যখন ইয়েরেভান বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম তখন স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটা।
ইমিগ্রেশন করার আগে ডলার এক্সচেঞ্জ করতে গেলে কথা হয় একজন আর্মেনিয়ান ব্যাংকারের  সঙ্গে। আমরা বাংলাদেশ থেকে আসছি শোনে তিনি বললেন, ‘আর্মেনিয়াতেও একটি বাংলাদেশ আছে’।
বিশ্বাস করতে না পেরে আমাদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা- ইজ ইট ফান? আর ইউ সিওর’। বললেন, নো নো, ইটস নট ফান। ইউ ক্যান ভিজিট দেয়ার’।
বিস্ময় নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে আমাদের রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছেন মূকাভিনয় উৎসব আয়োজক কমিটির প্রতিনিধিরা। বের হতেই দেখলাম ‘লিওনিড ইয়েঙবারিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মাইম ফেস্টিভাল’ লেখা পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন  দীর্ঘদেহী তরুণ-তরুণী। আমাদের দেখে এগিয়ে আসলেন।  কুশল বিনিমময় করে গাড়িতে উঠলাম।
বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় কথা হয় প্রতিনিধিদের একজন আর্মেনি মুহতাসিয়ান এর সঙ্গে। মুহতাসিয়ান ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী। একজন আর্টিস্ট। একই সঙ্গে জবও করেন। দেখতে বেশ সুন্দরী। বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে তিনিও জানালেন, ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি জেলা রয়েছে ইয়েরেভানে। কিন্তু কি কারণে বাংলাদেশ নামকরণ তা বলতে পারেননি।
বুঝতে পারলাম, আসলেই বাংলাদেশ নামের কিছু আছে এখানে। কেননা, আমাদের ঢাকায় যদি আর্মানিটোলা থাকতে পারে তবে আর্মেনিয়ায় বাংলাদেশ নামক কিছু নয় কেন?  আর্মানিটোলার ইতিহাসটি সংক্ষেপে তাদেরকে জানালাম আমরা। এতে তারাও বিস্মিত হলেন।
আর্মেনিয়ায় বাংলাদেশ নামক জেলার কথা ভাবতে ভাবতেই আমাদের জন্য বুকিং করা হোস্টেলে উঠলাম। রাতেই পরিকল্পনা করে নিয়েছি, সকালে প্রথম কাজ হবে বাংলাদেশ সফর করা।
সকালে উৎসব আয়োজক কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক এনা গেলস্টেনের সঙ্গে সাক্ষাতেও জানতে চাইলাম বাংলাদেশ জেলা প্রসঙ্গে। তিনিও এবিষয়ে নিশ্চিত নন। তার ধারণা, হয়তো কোন ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। আবারও এটিও বললেন যে, এলাকাটির আবহাওয়া তুলনামূলক গরম। আর বাংলাদেশের মতো এটিও দূরে অবস্থিত।বাংলাদেশিদের মতো এখানকার লোকদের মনও সুন্দর, আন্তরিক এবং নম্র। সম্ভবত এসব কারণেই সবাই এটিকে বাংলাদেশ নামে সম্বোধন করে থাকেন।
এনার সঙ্গে আলাপ সেরে দুপুরেই আমরা মস্কুভিয়ান স্ট্রিট থেকে ৯৯ নং বাসে যাত্রা করি আর্মেনিয়ান বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। পাহাড়-পর্বতের আর্মেনিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর ইয়েরেভানের আয়তন ৮৮ বর্গমাইল। উচ্চতা ৯৮৯.৪ মিটার (৩২৪৬.১ ফুট)।
 বাংলাদেশের উদেশ্যে ইয়েরেভানের মূল কেন্দ্র থেকে যতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছি  ততোই পাহাড় থেকে নিচের  দিকে যাচ্ছি। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। থেকে থেকে কিছু সবুজ মাঠ, খানিক সামনে গিয়ে যেতে  বিশাল একটি পুকুরও দেখা মিলল। পাহাড়ে সবুজ বৃক্ষও দেখতে পাচ্ছি। প্রথম কয়েকটি টিনের ঘরও দেখলাম।
 ৩০ মিনিট পর পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ জেলায়।দারুণ সাজানো- সুন্দর এই বাংলাদেশ। রাস্তায় বিল বোর্ডে ইংরেজি বানানের ‘বাংলাদেশ’ নাম খুঁজে পেলাম না। আর্মেনিয়ান ভাষায় সবকিছু লেখা। কিন্তু স্থানীয়রা উচ্চারণ করছেন ‘বাংলাদেশ’। গাড়ি চালক বলছেন, ‘বাংলাদেশ’ এসেছি , নেমে পড়ুন’!
গাড়ি থেকে নেমে স্থানীয় একটি দোকানে গিয়ে পরিচয় দিতেই কৌতূহলী দৃষ্টি দোকানদারের। ইংরেজি বলতে পারেন না। কিছুটা বুঝতে পারেন। সেলফি তোলার অফার দিলে রাজি হলেন। কথা প্রসঙ্গে দোকানের মালিক মি. জুনিয়েরনাইনের  কাছে জানতে চাইলাম বাংলাদেশ নামকরণ কেন? তার কথায় ব্যাপক হাসি পেলো। বললেন, -‘বাংলাদেশ তাই বাংলাদেশ’!
আসলে ঠিক কি কারণে এই এলাকার নাম সবার মুখে ‘বাংলাদেশ তা ঠিকভাবে কেউই বলতে পারছেন না। যদিও এই এলাকার অফিসিয়াল নাম জানা গেলো ‘মালাতিয়া সেবাস্তিয়া’।  গুগল সার্চ করে একই না পেলাম। আরো বেশি বিস্মিত হলাম একারণে যে, কোন বিল বোর্ডে বাংলাদেশ লেখা নেই। গুগলেও নেই। এরপরও আর্মেনিয়ানরা অফিসিয়াল নাম না বলে সবাই এই এলাকাকে বলছেন ‘বাংলাদেশ’। বাস চালক, যাত্রী, দোকানদার, অফিসার, পূলিশ যাকেই বলুন না কেন সবাই চিনেন বাংলাদেশ নামেই। এমনকি আমরা যখন নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলছি যে, ‘উই আর ফ্রম বাংলাদেশ’ তখন প্রথমে সবাই আর্মেনিয়ার বাংলাদেশই ধরে নেন। পরে আমাদের নিজের দেশের বর্ণনা দিলে বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট হয়। মনে প্রাণে সবাই এলাকাটিকে বাংলাদেশ বললেও তাদের নিকট এই নামের ইতিহাস জানা নেই।।
ঐতিহাসিক সূত্র থেকে ধারণা করা হয় যে, ঢাকায় আর্মানিটোলার একটি ঐতিহাসিক ধারা আর্মেনিয়ায় বাংলাদেশ নামে ভূমিকা রেখেছে। অষ্টাদশ শতকে ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি কারণে যেসব আর্মেনিয়ান বাংলায় সফর করেছিলেন তারা দেশে ফিরে সম্ভবত আর্মেনিয়ায় ‘বাংলাদশ’ নামকরণ করেন।
অন্যদিকে আর্মেনিয়ান একজন নৃবিজ্ঞানী লিলিট মির্জিওয়ান (Lilit Mirzoyan) এর লেখা একটি আর্টিকেল থেকে জানা গেলো এই এলাকার নাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এর কারণও তিনি বলেছেন। যেমন-ইয়েরেভানের অন্যান্য এলাকা থেকে তুলনামূলক নিচু স্থানে অবস্থিত, তুলনামূলক অনুন্নত, বাংলাদেশের মতো কিছুটা সবুজ অরণ্য ইত্যাদি মিলিয়ে এটির নাম বাংলাদেশ। ইয়েরেভানের লেখকের সেই আর্টিকেল আরো বলা হয়, আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান থেকেও এমন নামকরণ করা হতে পারে। অনেকের ধারণা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানিদের হামলার প্রতিবাদ এবং বাঙালি জাতির স্বাধীনতার প্রতি সম্মান স্বরূপও আর্মেনিয়ার ‘জেলা বাংলাদেশ নামে খ্যাতি অর্জন করে।  ইউটোব সার্চ করে ‘বাংলাদেশ,  বাংলাদেশ’ একটি গানও পাওয়া গেলো। এই গানটি শোনে প্রথমে মনে হতে পারে বাংলাদেশকে উৎসর্গ করেই গাওয়া হয়েছে গানটি। আসলে তা না। এটি আর্মেনিয়ান বাংলাদেশের প্রকৃতি নিয়ে গাওয়া গান।
ইয়েরেভান রেডিওর একজন সাংবাদিক দিদিয়ান ইউয়ং বাংলাদেশ গানটি অসাধারণ বললেন। তিনি এটিও বললেন যে, এই নামকরণ এর কিছু কারণ হতে পারে। এলাকাটি ইয়েরেভান থেকে দূরত্বে অবস্থিত, অধিকতর সবুজ ঘেরা, মনোরম, নিচু অঞ্চল এবং কিছুটা অনুন্নত। এটি একটি কারণ। আবার ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশকে সম্মান জানানোর জন্যও হতে পারে।
তবে সব তথ্যই অসমর্থিত সূত্র থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু এটি সত্য যে, ঢাকার আর্মানিটোলার সঙ্গে এখানে একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। এখানে আসা আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা নিজ দেশে ফিরে হয়তো ওখনকার জেলার নাম বাংলাদেশ নামে ডাকা শুরু করেন। আর তখন থেকে তা ব্যাপক পরিচিতি পায়।
যাইহোক, ইউরোপের দেশ আর্মেনিয়ার একটি জেলা শহরের নাম বাংলাদেশ। পুরো আর্মেনিয়ায় তা পরিচিত, এটাই একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের জন্য আনন্দের, গর্বের। বাংলাদেশ সরকার চাইলে আর্মেনিয়ার সরকারকে এই জেলার অফিসিয়াল  নাম ‘মালাতি সেবাস্তিয়া’র পরিবর্তে অধিকতর পরিচিত ও জনপ্রিয় ‘বাংলাদেশ’ নামকে অফিসিয়াল নামকরণ করার প্রস্তাব দিতে পারেন।
ইতোমধ্যে আর্মেনিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী আর্মেন আমিরিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতে আমরা সেই প্রস্তাবটি মৌখিকভাবে দিয়েও দিয়েছি। তিনি এবিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
দেশে ফিরে আসার পূর্বে আমরা দ্বিতীয়বার আর্মেনিয়ার বাংলাদেশে সফর করেছি। ফেরার সময় বারবার মনে হচ্ছিলো বোধয় কিছু রেখে যাচ্ছি, সত্যি রেখে যাচ্ছি… আবার ফিরবো হইতো কোন একদিন নামের স্বীকৃতি  নিয়ে। বাঙালি চেষ্টা করলে সবই সম্ভব…
সাইফুল্লাহ সাদেক, এমফিল গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রিসার্চ সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।